তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়।


তোরা সব জয়ধ্বনি কর - এ রকম ঘোষণা করেই বাংলা সাহিত্যে জগতে প্রবেশ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল হয়েছেন বাংলা সাহিত্যর অগ্নিপুরুষ, বাংলা সাহিত্য বরপুত্র এবং বাংলা সাহিত্য অন্যতম এক নিঃসংশয়তাবাদী কবি। জীবনানন্দ বলেছলেন - "উনিশ শতাব্দীর ইতিহাসপ্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম।"

এক ডিসেম্বরে, বছরের শেষ সপ্তাহে, কলকাতায়, শীতের রাত্রিতে খুব সম্ভবত রাত্রি জেগে নজরুল লিখেছিলেন-
" জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! " - জীবনানন্দের উক্তির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই বিদ্রোহী কবিতা। বিদ্রোহী'র ভিতরে রেনেসাঁসী প্রমূল্যসমূহ তার সবগুলি পাপড়ি মেলেছিল। ব্যক্তিসত্তার জয়গান পরিপূর্ণ উন্মোচনে ময়ূরের মতন চিৎকার করে উঠেছিল।

নজরুলের কবিতা এবং প্রবন্ধে বারবার উঠে এসেছিলো ভারতবর্ষের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। সাহিত্যে জগতের প্রারম্ভের সময় হতে বাকহীন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নজরুল সোচ্চার ছিলেন অন্যায় অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশদের অনল উপেক্ষা করে লিখেছিলেন 'আনন্দময়ীর আগমনে'। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ সালে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন তিনি। এক বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে। এই উপমহাদেশের কবিতার জন্য বাঙালি কবিদের মধ্যে দুজনকে কারাভোগ করতে হয়েছিলো যার একজন সৈয়দ ঈসমাইল হোসেন সিরাজী এবং কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল ছিলেন অনেকটা প্যানইসলামবাদী। নিজেকে সাথে মিশিয়ে নিয়েছিলেন প্যানইসলামিজমকে। নজরুলের লক্ষ্য ছিলো উপমহাদেশের শিল্প সাহিত্যে ইসলামের পুনরুজ্জীবন। ইসলামী পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্য ছিল বলেই নজরুল জীবনের প্রথম কবিতাগ্রন্থ অগ্নি-বীণায় ১২ টি কবিতার মধ্যে ৭ টি কবিতার বিষয়ই ইসলামী। কবিতাগুলো হলো, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানি ও মোহাররম।

এখন অনেকেই মনে করতে পারেন নজরুল ছিলেন সাম্প্রদায়িক একজন। যারা নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে চান তারা হয়তো জানেন না, হিন্দু মুসলমানের মিলনকামী নজরুল ১৯২২ সালে ধূমকেতু-র যেমন মোহাররম সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন তেমনি বের করেছিলেন দেয়ালী সংখ্যা।

দেবী দুর্গাকে তিনি যখন আহবান করছেন, তখন তিনি উচ্চারণ করেছেন -
" শ্বেত শতদল- বাসিনী নয় আজ
রক্তাম্বরধারিণী মা,
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা! "

তেমনি, আবার ইসলামের ইতিহাস নিয়ে যখন লিখেছেন তখন উচ্চারণ করেছেন-
" সখিনার শ্বেতবাস দেবো মাতা-কন্যায়
কাসিমের মতো জান রুধি অন্যায়
মোহররম! কারবালা! হায় হোসেন!
দেখো মরু-সূর্যে ও খুন যেন শোষে না। "

নজরুল তার জীবনে লিখেছেন অসংখ্য ইসলামী সংগীত। কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন ইসলামের নায়ক মহানায়কদের। তেমনি রচনা করেছেন অসংখ্য শ্যামা সংগীত৷ কবিতায় উপমা হিসেবে তুলে এনেছেন হিন্দুদের বিভিন্ন রথী-মহারথীকে।

এরপরেও আমাদের অনেকেই নজরুলকে অভিযুক্ত করতে চান সাম্প্রদায়িকতার দুষ্টে। আমরা তো এমনটাই করবো। কারণ আমরা হচ্ছি ললিত লবঙ্গলতা'র দেশের লোক।

১৯৩৭ সালের ১লা জুলাই কলকাতার গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম থেকে নার্গিসকে লেখা কবির প্রথম ও শেষ চিঠিতে কবি লিখেছিলেন " আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু, সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি- তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নি-বীণা বাজাতে পারতাম না - আমি ধমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। "

বাংলা কাব্যে নজরুলের তুলনা নেই। বাংলার বুকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিলো সেই আগুনের স্পর্শে বীণা হলো অগ্নি-বীণা। জাতীয় বিপ্লবের তিনিই সার্থক সাহিত্যিক- প্রতিভূ। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল।

0/একটি মন্তব্য / মন্তব্য পোস্ট করুন